গ্রামীণ-ব্যাংকের-ইতিহাস

গ্রামীণ ব্যাংকের ইতিহাস ও গ্রামীণ ব্যাংকের বর্তমান অবস্থা 

গ্রামীণ ব্যাংকের ইতিহাস জানার আগ্রহ আপনাদের অনেকের আছে। আপনাদের জানার আগ্রহ পূরণ করতে আজ এখানে পেয়ে যাচ্ছেন গ্রামীণ ব্যাংকের ইতিহাস ও গ্রামীণ ব্যাংকের বর্তমান অবস্থা । এর সাথে সাথে গ্রামীণ ব্যাংকের কার্যাবলী ও এর বর্তমান চেয়ারম্যান ও মালিক কে এই বিষয় সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা পেয়ে যাবেন এখানে।

 

গ্রামীণ ব্যাংক তার যাত্রা শুরু করে বাংলাদেশের একজন সনামধন্য ব্যক্তি ও নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ ডক্টর মোহাম্মদ ইউনেসের সাথে। 

 

চলুন তাহলে গ্রামীণ ব্যাংক সম্পর্কে প্রয়োজনীয় তথ্য জেনে নিতে পুরো পোস্টটি পড়ে নিন।

 

গ্রামীণ ব্যাংকের ইতিহাস 

গ্রামীণ ব্যাংকের ইতিহাস শুরু হয় ১৯৭৬ সালে, বাংলাদেশের নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূসের হাত ধরে। তিনি তখন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক ছিলেন। তার লক্ষ্য ছিল দারিদ্র্যপীড়িত মানুষের আর্থিক ক্ষমতায়ন ও সবার জন্য অর্থনৈতিক প্রবেশাধিকারের সুযোগ সৃষ্টি করা।

 

ড. ইউনূস লক্ষ করেন যে, প্রচলিত ব্যাংকিং ব্যবস্থা দরিদ্র মানুষকে ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে অনাগ্রহী। ফলে তিনি নিজের উদ্যোগে চট্টগ্রামের জোবরা গ্রামে ক্ষুদ্রঋণের একটি প্রকল্প শুরু করেন। প্রথমে ৪২ জন মানুষকে মাত্র $২৭ ঋণ দিয়ে এই প্রকল্পের সূচনা হয়।

 

১৯৮৩ সালে, এই ক্ষুদ্রঋণ প্রকল্পটি আনুষ্ঠানিকভাবে গ্রামীণ ব্যাংক নামে প্রতিষ্ঠিত হয়। এই ব্যাংকটি প্রধানত দরিদ্র, বিশেষত গ্রামীণ মহিলাদের স্বাবলম্বী করার উদ্দেশ্যে কাজ করে। ক্ষুদ্রঋণ বা মাইক্রোক্রেডিটের মাধ্যমে দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে ঋণ দেওয়া শুরু হয়, যাতে তারা ছোট ব্যবসা শুরু করতে পারে এবং অর্থনৈতিকভাবে স্বাধীন হতে পারে।

 

গ্রামীণ ব্যাংকের সাফল্য দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে এবং আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পায়। ২০০৬ সালে, ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও গ্রামীণ ব্যাংক যৌথভাবে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন। 

 

গ্রামীণ ব্যাংকের মডেলটি বিশ্বব্যাপী দারিদ্র্য বিমোচনের একটি আদর্শ হিসেবে পরিচিতি লাভ করে এবং অনেক দেশেই এই মডেল অনুকরণ করা হয়েছে।

 

গ্রামীণ ব্যাংকের মালিক কে

গ্রামীণ ব্যাংকের মালিকানা মূলত তার ঋণগ্রহীতা গ্রাহকদের মধ্যে ভাগ করা। ব্যাংকের মালিকানা কাঠামোতে, গ্রাহকরা ব্যাংকের ৯৭% শেয়ারের মালিক, আর বাকি ৩% শেয়ার সরকারের অধীনে রয়েছে। অর্থাৎ, যারা গ্রামীণ ব্যাংক থেকে ঋণ নেন এবং নিয়মিত ঋণ পরিশোধ করেন, তারাই মূলত ব্যাংকের শেয়ারহোল্ডার হিসেবে বিবেচিত হন। গ্রামীণ ব্যাংকের মালিক কে।

 

এই ব্যবস্থার মাধ্যমে, গ্রামীণ ব্যাংক গ্রাহকদের মধ্যে আর্থিক স্বাধীনতা এবং ব্যাংকের পরিচালনায় তাদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করে। 

 

গ্রামীণ ব্যাংকের বর্তমান পরিচালক কে 

গ্রামীণ ব্যাংকের ইতিহাস ও গ্রামীণ ব্যাংকের বর্তমান পরিচালক কে জেনে নিন। গ্রামীণ ব্যাংকের বর্তমান ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) নূর মোহাম্মদ।  তিনি 2024 সালের জানুয়ারিতে এই পদে নিযুক্ত হন। এমডি হওয়ার আগে, 1989 সালে শুরু হওয়া ব্যাংকে তার দীর্ঘ কর্মজীবন ছিল এবং উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক, প্রোগ্রাম অফিসার এবং এরিয়া ম্যানেজারের মতো বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন।  তিনি দারিদ্র্য বিমোচনে ব্যাংকের প্রচেষ্টায় উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছেন (TBS News) (Grameen Bank)।

আরও পড়তে ভিজিট করুনঃ 

সরকারি আয়ের খাত কোনটি এবং কি কি

 

গ্রামীণ ব্যাংকের কার্যাবলী ও গ্রামীণ ব্যাংকের ইতিহাস 

গ্রামীণ ব্যাংকের ইতিহাস জানার পর জেনে নিন ব্যাংকের কার্যাবলী গুলো। গ্রামীণ ব্যাংকের প্রধান কার্যাবলী হল দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী করতে সহায়তা করা, বিশেষত গ্রামীণ নারীদের আর্থিক ক্ষমতায়ন। ব্যাংকটি নিম্নলিখিত কার্যক্রমগুলো পরিচালনা করে:

 

ক্ষুদ্রঋণ প্রদান (Microcredit): 

গ্রামীণ ব্যাংকের মূল কাজ হলো দরিদ্র মানুষকে জামানতবিহীন ঋণ প্রদান করা। এই ঋণের মাধ্যমে গ্রাহকরা ছোট ব্যবসা শুরু করতে পারেন, যা তাদের আর্থিক স্বাধীনতা অর্জনে সহায়তা করে।

 

ঋণ পুনর্বিন্যাস (Loan Restructuring): 

গ্রামীণ ব্যাংক গ্রাহকদের আর্থিক সক্ষমতার ভিত্তিতে ঋণ প্রদান এবং পরিশোধের শর্তগুলো পুনর্নির্ধারণ করে।

 

সঞ্চয় পরিকল্পনা (Savings Programs): 

ব্যাংকটি বিভিন্ন সঞ্চয় প্রকল্প পরিচালনা করে, যেমন মাসিক সঞ্চয়, পেনশন স্কিম, এবং দীর্ঘমেয়াদী সঞ্চয় স্কিম, যা গ্রাহকদের ভবিষ্যৎ আর্থিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করে।

 

বীমা সেবা (Insurance Services): 

গ্রামীণ ব্যাংক ঋণগ্রহীতাদের জন্য ঋণ বীমা এবং স্বাস্থ্য বীমা সেবা প্রদান করে, যা তাদের জীবনযাত্রার মান উন্নত করতে সহায়ক।

 

বৃক্ষরোপণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা (Tree Plantation and Disaster Management): 

ব্যাংকটি সামাজিক উন্নয়নের জন্য বৃক্ষরোপণ কার্যক্রম এবং দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা প্রকল্প পরিচালনা করে।

 

শিক্ষা এবং প্রশিক্ষণ (Education and Training): 

গ্রামীণ ব্যাংক গ্রাহকদের শিক্ষাগত সহায়তা প্রদান এবং বিভিন্ন প্রশিক্ষণ কর্মসূচি পরিচালনা করে, যা তাদের দক্ষতা উন্নয়নে সহায়ক।

 

গ্রামীণ ব্যাংকের কার্যক্রম মূলত দরিদ্র জনগোষ্ঠীর আর্থসামাজিক উন্নয়নে কেন্দ্রিত, যা দারিদ্র্য বিমোচন এবং সামগ্রিক উন্নয়নের লক্ষ্যে কাজ করে।

 

গ্রামীণ ব্যাংকের সুদের হার কত

গ্রামীণ ব্যাংকের সুদের হার বিভিন্ন ঋণ প্রকল্পের উপর নির্ভর করে ভিন্ন হতে পারে। গ্রামীণ ব্যাংকের সুদের হার নিম্নলিখিতভাবে নির্ধারণ করে থাকে। 

 

ক্ষুদ্রঋণ (Microcredit): 

ক্ষুদ্রঋণগুলির জন্য বার্ষিক সুদের হার সাধারণত ২০% এর কাছাকাছি হয়ে থাকে। এটি মূলত সাপ্তাহিক কিস্তিতে পরিশোধযোগ্য হয়।

 

আবাসন ঋণ (Housing Loan): 

আবাসন ঋণের ক্ষেত্রে সুদের হার অপেক্ষাকৃত কম, যা সাধারণত ৮% থেকে ১০% এর মধ্যে হয়ে থাকে।

 

শিক্ষা ঋণ (Higher Education Loan): 

উচ্চশিক্ষার জন্য দেওয়া ঋণে সুদের হার ৫% থেকে ৮% পর্যন্ত হতে পারে, যা শিক্ষার্থীদের জন্য সহনশীল করা হয়েছে।

 

সুদের হার সময় ও পরিস্থিতির উপর ভিত্তি করে পরিবর্তিত হতে পারে। সঠিক তথ্যের জন্য গ্রামীণ ব্যাংকের সাথে সরাসরি যোগাযোগ করা উত্তম।

 

গ্রামীণ ব্যাংকের বর্তমান অবস্থা 

গ্রামীণ ব্যাংকের ইতিহাস জানার সাথে সাথে জেনে নিন গ্রামীণ ব্যাংকের বর্তমান অবস্থা। গ্রামীণ ব্যাংক বর্তমানে বাংলাদেশের প্রায় ৯৪% গ্রামে কার্যক্রম পরিচালনা করছে এবং প্রায় ১০.৬ মিলিয়ন ঋণগ্রহীতা সদস্যকে সেবা প্রদান করে যাচ্ছে। 

 

২০২৪ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত, ব্যাংকটি প্রায় ৪৫ মিলিয়ন মানুষকে (পরিবার সহ) সেবা দিচ্ছে। ব্যাংকের মোট ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১.৪৭৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলার এবং ঋণ পুনরুদ্ধারের হার ৯৬.৭৯%।

 

গ্রামীণ ব্যাংক মূলত ক্ষুদ্রঋণ প্রদান করে, যেখানে প্রায় ৯৮% ঋণগ্রহীতা নারী। এটি নারী ক্ষমতায়ন ও দারিদ্র্য দূরীকরণের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। এছাড়াও শিক্ষাবৃত্তি, উচ্চশিক্ষা ঋণ এবং ব্যবসায়িক ঋণ প্রদানের মাধ্যমে পরিবারগুলোর জীবনমান উন্নয়নের লক্ষ্যে কাজ করছে।

 

তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ব্যাংকের পরিচালনার ক্ষেত্রে কিছু চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছে। ২০১৩ সালের একটি নতুন আইন সরকারকে ব্যাংকের কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা দেয়, যা ব্যাংকের স্বায়ত্তশাসনের ওপর প্রভাব ফেলেছে।

 

সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, গ্রামীণ ব্যাংকের ঋণ প্রদানের পাশাপাশি সঞ্চয় প্রকল্প এবং অন্যান্য ক্ষুদ্রঋণ সুবিধার মাধ্যমে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে অবদান রেখে যাচ্ছে (Grameen Bank) (Wikipedia) (Grameen Bank) ।

 

শেষ কথা 

গ্রামীণ ব্যাংকের ইতিহাস সম্পর্কে জানার‌ পর বলা যায় যে, বাংলাদেশের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য একটি বৈপ্লবিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে ১৯৮৩ সালে প্রতিষ্ঠিত এই ব্যাংকটি মূলত ক্ষুদ্রঋণ মডেলের মাধ্যমে দরিদ্র মানুষদের অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী করে তুলেছে।

 

বর্তমানে এটি প্রায় ১০.৬ মিলিয়ন গ্রাহককে সেবা দিয়ে যাচ্ছে, যার মধ্যে ৯৮% নারী। গ্রামীণ ব্যাংক শুধু ক্ষুদ্রঋণই নয়, সঞ্চয়, শিক্ষাবৃত্তি, এবং আবাসন ঋণসহ বিভিন্ন সেবা প্রদান করে।

 

ব্যাংকের ঋণ পুনরুদ্ধারের হার ৯৬.৭৯%, যা কার্যক্রমের সাফল্যের অন্যতম মাপকাঠি। তবে, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সরকারের নিয়ন্ত্রণ ও অন্যান্য চ্যালেঞ্জ ব্যাংকের কার্যক্রমের ওপর প্রভাব ফেলেছে। তবুও, গ্রামীণ ব্যাংক তার মূল লক্ষ্য—দারিদ্র্য বিমোচন এবং নারী ক্ষমতায়নের ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে।

 

প্রায়শই জিজ্ঞাসিত প্রশ্ন 

১. প্রশ্নঃ গ্রামীণ ব্যাংকের উদ্দেশ্য কি?

উত্তরঃ গ্রামীণ ব্যাংকের উদ্দেশ্য হলো দারিদ্র্য বিমোচন এবং গ্রামীণ জনগণের অর্থনৈতিক উন্নয়ন। এটি মূলত গরীব মানুষের কাছে ক্ষুদ্রঋণ প্রদান করে তাদের ব্যবসায়িক উদ্যোগ শুরু করতে এবং জীবনমান উন্নত করতে সহায়তা করে।

 

২. প্রশ্নঃ গ্রামীণ ব্যাংক ভূমিহীনদের ঋণ প্রদান করে কিভাবে? 

উত্তরঃ গ্রামীণ ব্যাংক ভূমিহীনদের ঋণ প্রদান করে সাধারণত সামাজিক নিরাপত্তার নেটওয়ার্ক এবং স্বতন্ত্র উদ্যোক্তা হিসেবে তাদের সহায়তা করতে। তারা গ্রামীণ জনগণের জন্য ক্ষুদ্রঋণ প্রদান করে, যা ব্যবসায়িক কার্যক্রম শুরু করতে বা বাড়াতে ব্যবহৃত হয়। ঋণের শর্ত সাধারণত সহজ এবং অল্প সুদে প্রদান করা হয়, যাতে গ্রাহকরা সহজে পরিশোধ করতে পারে।

 

৩. প্রশ্নঃ গ্রামীণ ব্যাংকের শাখা কয়টি?

উত্তরঃ গ্রামীণ ব্যাংকের শাখার সংখ্যা পরিবর্তনশীল হতে পারে, তবে ২০২৩ সালের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশের গ্রামীণ ব্যাংকের শাখার সংখ্যা প্রায় ২৮০০ এর কাছাকাছি। সবচেয়ে আপডেট তথ্যের জন্য অফিসিয়াল সাইট বা সংস্থার যোগাযোগ ব্যবস্থা চেক করতে পারেন।